জুলাই বিপ্লবের ফলে বুরবোঁ রাজবংশের পরিবর্তে ফ্রান্সের সিংহাসনে বসেন অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ নেতৃত্বে জুলাই রাজতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা হয়। কিন্তু ১৮ বছরের মধ্যেই ১৮৪৮ –এর ফেব্রুয়ারি মাসে আর এক অভ্যুত্থানে এই জুলাই রাজতন্ত্রের -ও পতন হয়, ফলে ফ্রান্সে প্রতিষ্ঠিত হয় দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র।
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের কারণ:
ফেব্রুয়ারি বিপ্লব সংগঠনের কারণগুলি হল-
খাদ্য সংকট:
১৮৪৬-৪৭ খ্রিস্টাব্দের খাদ্য সংকট জুলাই রাজতন্ত্রের পতনের অন্যতম প্রধান কারণ।
শিল্পে মন্দা:
খাদ্য সংকটের কারণে খাদ্যের দাম বাড়লে মানুষজনের শিল্পদ্রব্য ক্রয়ের ক্ষমতা হ্রাস পায়। এজন্য শিল্পে মন্দা দেখা দেয়। যার ফলশ্রুতি হিসাবে লুই ফিলিপের পতন ঘটে।
শ্রমিক অসন্তোষ:
ফ্রান্সে শ্রমিক শ্রেণি অত্যন্ত দূরাবস্থার মধ্যে দিন কাটাত। লুই ফিলিপ শ্রমিক কল্যাণমূলক কোনরূপ পদক্ষেপ গ্রহণ করেননি। ফলে শ্রমিকশ্রেণি প্রজাতন্ত্রীদের সঙ্গে যােগ দিয়ে বিদ্রোহের জন্য গুপ্তসমিতি গঠন করে।
লুই ফিলিপের ব্যক্তিত্বের অভাব:
ফ্রান্সের ন্যায় দেশ শাসন করতে যে প্রতিভা ও ব্যক্তিত্বের প্রয়ােজন ছিল, তা লুই ফিলিপের ছিল না।
ক্রুটিপূর্ণ বিদেশনীতি:
লুই ফিলিপ যে -কোনো মূল্যে বৈদেশিক যুদ্ধ এড়িয়ে শান্তি রক্ষা করার নীতি গ্রহণ করেন। তিনি—
(১) পোল্যান্ড ও ইটালির জাতীয়তাবাদী আন্দোলনে নিরপেক্ষ থাকেন।
(২) বেলজিয়ামের স্বাধীনতা যুদ্ধের নেতৃত্ব গ্রহণে ব্যর্থ হন।
(৩) মিশর ও তুরস্কের বিরোধে ভুল নীতি গ্রহণ করেন।
(৪) আফ্রিকা ও নিকট প্রাচ্যে ভুল বিদেশনীতি গ্রহণ করেন। এরূপ দুর্বল ও নিষ্ক্রিয় বিদেশনীতি দেশবাসীকে ক্ষুব্ধ করে।
প্রত্যক্ষ কারণ:
সমগ্র ফ্রান্সে আইনসভার দুর্নীতির বিরুদ্ধে তীব্র আন্দোলন শুরু হয়। ক্ষুব্ধ জনতার একটি অংশ প্রধানমন্ত্রী গুইজো -র বাসভবনের সামনে বিক্ষোভ দেখালে সরকারী রক্ষীবাহিনী তার উপর গুলি চালায়। ফলে বিক্ষোভ চরমে পৌছায়। উপায় নেই দেখে ২৪শে ফেব্রুয়ারি রাজা লুই ফিলিপ পদত্যাগ করেন।
ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলাফল:
জুলাই বিপ্লবের (১৮৩০ খ্রিঃ) দ্বারা ফ্রান্সে অর্লিয়েন্স বংশীয় লুই ফিলিপ সিংহাসনে বসেন। মাত্র দুই দশকেরও কম সময়ের মধ্যে তাঁর শাসনের বিরুদ্ধে ফ্রান্সে তীব্র ক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে এবং ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে ফ্রেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে তাঁর পতন ঘটে।
ফ্রান্সের অভ্যন্তরে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের বিভিন্ন ফলাফল প্রত্যক্ষ করা যায় যেমন—
প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠা :
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে ফ্রান্সে অর্লিয়েন্স রাজবংশের পতন ঘটে এবং দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়। নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার বিভিন্ন জনকল্যাণমূলক পদক্ষেপ ঘোষণা করে।
নতুন আইনসভা গঠন:
বিপ্লবের ফ্রান্সের ভোটাধিকারের ভিত্তিতে এককক্ষবিশিষ্ট আইনসভা গঠিত হয়। এই আইনসভা লুই নেপোলিয়নকে চার বছরের জন্য রাষ্ট্রপতি হিসেবে নিযুক্ত করে।
ভোটাধিকার:
ভোটাধিকার সম্প্রসারণের ফলে ফ্রান্সের সাধারণ নিম্নবিত্ত বুর্জোয়ারা ভোটদানের এবং রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভের সুযোগ পায়।
শ্রমিককল্যাণ:
নতুন প্রজাতান্ত্রিক সরকার শ্রমিকশ্রেণির উন্নতির জন্য শ্রম কমিশন গঠন করে। শ্রমিকদের কাজের সময়সীমা বেঁধে দেওয়া হয়।
বেকারদের জন্য পদক্ষেপ:
প্রজাতান্ত্রিক সরকার সকলের জন্য কাজের অধিকারের স্বীকৃতি দেয়। ‘জাতীয় কর্মশালা’ স্থাপন করে বেকারদের কাজের সুযোগ করা হয়।
ইউরোপে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব:
জার্মানিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব:
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে জার্মানির প্রাশিয়া, স্যাক্সনি, হ্যানোভার, ব্যাভেরিয়া, ব্যাডেন প্রভৃতি রাজ্যে উদারনৈতিক গণ-আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনের চাপে এসব রাজ্যের শাসকগণ উদারনৈতিক সংস্কার করতে বাধ্য হন।
ইটালিতে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব:
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ইটালির পার্মা, মডেনা, ভেনিস, টাস্কোনি, সিসিলি, নেপলস্, পোপের রাজ্য প্রভৃতিতে বিদ্রোহ ছড়িয়ে পড়ে। এর প্রভাবে কয়েকটি রাজ্যে প্রজাতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হয়।
অস্ট্রিয়ায় বিপ্লবের প্রভাব:
মেটারনিখের নিজ সাম্রাজ্য অস্ট্রিয়ায় বিদ্রোহ ভয়ঙ্কর রূপ ধারণ করে। বিদ্রোহী জনতা রাজধানী ভিয়েনায় মেটারনিখের বাসভবন আক্রমণ করলে মেটারনিখ পালিয়ে ইংল্যাণ্ডে আশ্রয় নেন। অস্ট্রিয়ায় উদারনৈতিক সংবিধান চালু হয়।
ডেনমার্কে ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাব:
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের প্রভাবে ডেনমার্কের রাজা সপ্তম ফ্রেডারিক সংবিধান সভার অধিবেশন ডাকতে বাধ্য হন।
উপসংহার:
ফেব্রুয়ারি বিপ্লবের ফলে প্রতিষ্ঠিত প্রজাতান্ত্রিক সরকার সার্বজনীন ভোটাধিকার, শিক্ষাবিস্তার, শ্রমিকদের স্বার্থরক্ষা, বেকারত্ব দূর করা প্রভৃতি বিভিন্ন ইতিবাচক উদ্যোগ গ্রহণ করে। এজন্য কার্ল মার্কস ফেব্রুয়ারি বিপ্লবকে ‘সুন্দর বিপ্লব’ বলে অভিহিত করেছেন।
0 মন্তব্যসমূহ