মার্কসবাদের মৌলিক উপাদানগুলির মধ্যে সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হল দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ (Dialectical Materialism)। এই দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের সাহায্যে কার্ল মার্কস মানবসমাজের উদ্ভব ও বিকাশের ইতিহাস বিশ্লেষণ করেছেন। মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদকে বৈজ্ঞানিক দার্শনিক বিশ্ববীক্ষা রূপে অভিহিত করা হয়।
কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের ব্যাখ্যা:
মার্কসীয় দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মূল কথাকে দুটি অংশে ভাগ করা হয়েছে।
- অচেতন অংশ। যার মূল কথা হল বস্তু।
- সচেতন অংশ। যার মূল কথা হল মন বা ভাব।
কার্ল মার্কস হেগেলের দ্বন্দ্বমূলক ভাববাদের সঙ্গে ফয়েরবাখের বস্তুবাদের মিলন ঘটিয়ে দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদে পরিণত করেছেন। কার্ল মার্কস দেখিয়েছেন যে, মহাবিশ্বের প্রতিটি বস্তুর মধ্যে বিরোধের বীজ বর্তমান। একইসঙ্গে পরস্পরবিরোধী শক্তিও নিহিত থাকে। এর একটিকে বলা হয় বাদ (Thesis), অপরটিকে বলা হয় প্রতিবাদ (Antithesis)। আর উভয়ের মধ্যে সংঘাতের ফলে উন্নততর এক অবস্থার জন্ম হয় যাকে বলা হয় সম্বাদ (Synthesis)। পুরোনো থেকে যখন নতুনের আবির্ভাব ঘটে তখন নতুন, পুরোনোর চাইতে গুণগত দিক থেকে উন্নত বৈশিষ্ট্য নিয়ে আসে।
দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের মৌলিক সূত্র:
মার্কসের দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের তিনটি মৌলিক সূত্র হল—
বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব: প্রতিটি বস্তু ও ঘটনার মধ্যে পরস্পরবিরোধী ধর্ম বর্তমান এবং তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব বা বিরোধই বস্তুর পরিবর্তন ঘটায়।
যেমন— পুঁজিবাদী সমাজে পুঁজিপতি মালিক ও শ্রমিক শ্রেণির মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্বই সমাজ পরিবর্তনের মূল কারণ। দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ অনুসারে বৈপরীত্যের দ্বন্দ্ব বিভিন্ন ধরনের হতে পারে।
যেমন— বৈর ও অবৈর দ্বন্দ্ব, অন্তর্দ্বন্দ্ব প্রভৃতি।
বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তনের সঙ্গে গুণগত পরিবর্তন: মার্কসের মতে, পুঁজিবাদী সমাজের পরিমাণগত পরিবর্তনের প্রক্রিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে গুণগত পরিবর্তন ঘটিয়ে সমাজতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার সৃষ্টি হয়। দ্বান্দ্বিক প্রক্রিয়ায় বিপরীতধর্মী শক্তির দ্বন্দ্বের ফলে বস্তুর পরিমাণগত পরিবর্তন থেকে গুণগত পরিবর্তন ঘটে।
নেতির নেতিকরণ বা অস্বীকৃতির অস্বীকৃতি: পুরোনোকে অস্বীকার না করলে নতুনের আবির্ভাব ঘটে না। নতুন ক্রমে পুরোনো হয় এবং তারও পরিবর্তন ঘটে, জন্ম হয় অধিকতর নতুনের। এইভাবেই দাস সমাজব্যবস্থা থেকে সামন্ত সমাজ, পরে সামন্ত সমাজকে অস্বীকার করে পুঁজিবাদী সমাজ, আবার পুঁজিবাদী সমাজকে অস্বীকার করে সমাজতান্ত্রিক সমাজের বিকাশ ঘটে।
সমালোচনা: কার্ল মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ বিভিন্নভাবে সমালোচিত হয়েছে।
যেমন— কার্ল মার্কসের বিপ্লব সম্পর্কে বা উন্নত সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার ভবিষ্যদ্বাণীও বাস্তবায়িত হয়নি এবং শিল্পোন্নত পুঁজিবাদী দেশেও বিপ্লব সংঘটিত হয়নি।
পরিশেষে বলা যায়, দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদের তাত্ত্বিক মূল্য ও গুরুত্ব আজও অপরিসীম। মার্কসের দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ একটি যুগান্তকারী রাজনৈতিক দর্শন।
0 Comments: