
গৌতম বুদ্ধের জীবন:
বৌদ্ধ ধর্মের প্রতিষ্ঠাতা গৌতম বুদ্ধ, সিদ্ধার্থ রূপে জন্মগ্রহণ করেন। সিদ্ধার্থ খ্রিস্টপূর্ব ৫৬৭ সালে লুম্বিনীতে (বর্তমানে নেপালের ভূখণ্ডে পড়ে) ক্ষত্রিয় বংশের শাক্য বংশে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি ৮০ বছর বয়সে ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুশিনগরে (উত্তর প্রদেশের গোরখপুরের কাছে) মৃত্যুবরণ করেন। সিদ্ধার্থের মা ছিলেন 'মহামায়া' যিনি তাকে জন্ম দেওয়ার পর মারা যান। অতঃপর, তিনি তাঁর সৎ মা 'প্রজাপতি গৌতমী' দ্বারা লালিত-পালিত হন। তাই তাকে গৌতম নামেও ডাকা হয়। পিতার নাম ছিল সিদ্ধোধন। তিনি ছিলেন পিতার একমাত্র পুত্র। যশোধরার সাথে সিদ্ধার্থের বিয়ে হয়েছিল। রাহুল নামে তার একটি ছেলেও ছিল। কিন্তু তার স্ত্রী বা পুত্র কেউই তাকে পার্থিব জীবনে বাঁধতে পারেন।মহাভিষ্ক্রমণ:
গৌতম বুদ্ধ সত্যের সন্ধানে এবং দুঃখের অবসানে ২৯ বছর বয়সে গৃহত্যাগ করেন ও তপস্বী হন। বুদ্ধের জীবনের এই ঘটনাটি 'মহাভিষ্ক্রমণ' নামে পরিচিত।
ধর্মচক্র প্রবর্তন:
বুদ্ধের শিক্ষক ছিলেন আলারা ও উদরক। সাত বছর ঘোরাঘুরি করার পর, ৩৫ বছর বয়সে সিদ্ধার্থ নিরঞ্জনা নদীর তীরে একটি পিপল (বট) গাছের নীচে ধ্যান করার সময় উরুভেলায় জ্ঞান লাভ করেন। এই গাছকে বোধি গাছ বলা হয়। স্থানটি 'বোধগয়া' নামে পরিচিত। বৈশাখ মাসের পূর্ণিমায় বুদ্ধ জ্ঞান লাভ করেন। গৌতম বুদ্ধ সারনাথে (বারাণসী) প্রথম ধর্মোপদেশ দেন। বুদ্ধের জীবনের এই ঐতিহাসিক ঘটনাটি 'ধর্মচক্র প্রবর্তন' নামে পরিচিত।
বৌদ্ধ দর্শন:
বৌদ্ধ দর্শন মধ্যমা মার্গ বা মধ্যপথের উপর ভিত্তি করে। মধ্যমার্গ দর্শন অনুসারে, জগতের উভয় চরম- ভোগ এবং কঠোর পরিহার উভয়ই পরিহার করা হয় এবং উভয়ের মধ্যে একটি মধ্যম পথ অনুসরণ করা হয়।
আর্য সত্য:
বুদ্ধের প্রধান শিক্ষাগুলি বৌদ্ধধর্মের চারটি মহৎ সত্য বা আর্য সত্য বলা হয়ে থাকে।
আর্য সত্য গুলি হল:
- পৃথিবী দুঃখে পূর্ণ।
- কামনাই দুঃখের কারণ।
- ইচ্ছা জয় হলে সব দুঃখ জয় হয়।
- আটটি পথ (অষ্টাঙ্গিক মার্গ) অনুসরণ করে ইচ্ছাকে জয় করা যায়।
অষ্টাঙ্গিক মার্গ:
দুঃখ অবসানের মার্গ বা উপায়কে অষ্টাঙ্গিক মার্গ বলে। এই আটটি মার্গ একত্রে দুঃখের অবসান ঘটায়। এই মার্গগুলি আটটি বিভিন্ন স্তর নয়, বরং একে অপরের ওপর নির্ভরশীল পরস্পর সংযুক্ত হয়ে একটি সম্পূর্ণ পথের সৃষ্টি করে।
আটটি মার্গ হলো–
সম্যক (সৎ) দৃষ্টি: সঠিক উপলব্ধি, যার ফলে চতুরার্য সত্যগুলোর প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করতে পারা।
সম্যক (সৎ) সংকল্প: সত্যলাভ করার জন্য দৃঢ় বাসনা রাখা।
সম্যক (সৎ) বাক্য: মিথ্যাকথা, কঠোরবাক্য, পরনিন্দা, বৃথা আলাপ ও মূর্খের মতো বাক্যালাপ থেকে নিবৃত্ত থাকা।
সম্যক (সৎ) আচরণ: প্রাণীহত্যা, চুরি, অন্যায় বিচার ও অসংযম হতে সম্পূর্ণ রূপে নিজেকে বিরত রাখা।
সম্যক (সৎ) আজীব: সুস্থ ও সবলতার জন্য সৎ উপায়ে জীবন ধারন করা। জীবন নির্বাহের জন্য প্রয়োজনীয় প্রচেষ্টা সম্পূর্ণ রূপে পাপ ও কলূষমুক্ত হওয়া।
সম্যক (সৎ) প্রচেষ্টা: মনকে শুদ্ধ ও পবিত্র রাখার জন্য সব সময় অন্যায় কাজ হতে বিরত থাকার ও ভালো কাজের চেষ্টা করা।
সম্যক (সৎ) স্মৃতি: দেহে ও মনে সম্পূর্ণ সজাগ ও সচেতন থাকা।
সম্যক (সৎ) সমাধি: ধ্যান অর্থাৎ পরিপূর্ণ একাগ্রতার নাম ধ্যান বা সমাধি। বা সমাধির চারটি স্তর। শেষ স্তরে নির্বাণ লাভ হয়। এ অবস্থায় মানুষের মোহ ও অবিদ্যা চির তরে দূর হয়ে জন্ম এবং দুঃখের পরিসমাপ্তি ঘটে।
বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস:
- খ্রিস্টপূর্ব ৪৮৬ সালের দিকে গৌতম মারা গেলে, তার অনুসারীরা একটি ধর্মীয় আন্দোলন সংগঠিত করতে শুরু করে। বুদ্ধের শিক্ষাই বৌদ্ধধর্মে কী বিকাশ লাভ করবে তার ভিত্তি হয়ে ওঠে।
- খ্রিস্টপূর্ব ৩য় শতকে, মৌর্য ভারতীয় সম্রাট অশোক দ্য গ্রেট বৌদ্ধধর্মকে ভারতের রাষ্ট্রধর্মে পরিণত করেন। বৌদ্ধ মঠ তৈরি করা হয়েছিল, এবং ধর্মপ্রচারক কাজকে উৎসাহিত করা হয়েছিল।
- পরবর্তী কয়েক শতাব্দীতে বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে।বৌদ্ধদের চিন্তাভাবনা এবং দর্শন বৈচিত্র্যময় হয়ে ওঠে, কিছু অনুসারী অন্যদের চেয়ে ভিন্নভাবে ধারণার ব্যাখ্যা করে।
- ষষ্ঠ শতাব্দীতে, হুনরা ভারত আক্রমণ করে এবং শত শত বৌদ্ধ বিহার ধ্বংস করে, কিন্তু অনুপ্রবেশকারীরা শেষ পর্যন্ত দেশ থেকে বিতাড়িত হয়।
- মধ্যযুগে ইসলাম দ্রুত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করে, বৌদ্ধ ধর্মকে পটভূমিতে বাধ্য করে।
বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ:
বৌদ্ধরা অনেক পবিত্র গ্রন্থ এবং ধর্মগ্রন্থকে শ্রদ্ধা করে। তাদের ধর্ম গ্রন্থের নাম ত্রিপিটক।
বিনয় পিটক: এটি বৌদ্ধ মঠে শৃঙ্খলার নিয়ম নিয়ে গঠিত।
সুত্ত পিটক: এটি বুদ্ধের উপদেশের বৃহত্তম সংগ্রহ।
অভিধম্ম পিটক: এতে বৌদ্ধ ধর্মের দার্শনিক নীতির ব্যাখ্যা রয়েছে।
বৌদ্ধ সংগীতি:
বিভিন্ন শাসনের অধীনে বৌদ্ধধর্মের চারটি পরিষদ/সংগীতি সংগঠিত ছিল:
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি:
প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে অজাতশত্রুর (হর্ষঙ্ক রাজবংশ) পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। প্রথম কাউন্সিলে সভাপতিত্ব করেন সন্ন্যাসী মহাকাস্যপ। এটি বুদ্ধের মৃত্যুর পর রাজগৃহের সত্তাপানি গুহায় অনুষ্ঠিত হয়েছিল। বিনয়পিটক ও সুত্তপিটকের সংকলন এখানেই সম্পন্ন হয়েছিল।
দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি:
৩৮৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কালাশোক (শিশুনাগ রাজবংশ) এর পৃষ্ঠপোষকতায় দ্বিতীয় বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটি বুদ্ধের মৃত্যুর (পরিনির্বাণ) এক শতাব্দী পরে বৈশালীতে অনুষ্ঠিত হয়েছিল। দ্বিতীয় পরিষদের সভাপতিত্ব করেন সর্বকামি।
তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি:
২৫০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে রাজা অশোকের পৃষ্ঠপোষকতায় তৃতীয় বৌদ্ধ সংগীতি পাটলিপুত্রে অনুষ্ঠিত হয়। এর সভাপতিত্ব করেন মোগালিপুত্তম। অভিধামপিটক সংকলন করা হয়েছিল এই সভায়।
চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি:
খ্রিস্টীয় ১ম শতাব্দীতে, রাজা কনিষ্কের (কুশান রাজবংশ) পৃষ্ঠপোষকতায় চতুর্থ বৌদ্ধ সংগীতি অনুষ্ঠিত হয়েছিল কাশ্মীরের কুন্ডলবনে। অশ্বঘোষ সহ-সভাপতি ও বসুমিত্রের সভাপতিত্বে। বৌদ্ধ ধর্ম হীনযান ও মহাযান নামে দুটি সম্প্রদায়ে বিভক্ত ছিল।
উপরে উল্লিখিত হিসাবে, বুদ্ধ ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে কুশীনগরের একটি শাল গাছের নিচে (কুশীনগর লিচ্ছবি রাজ্যের অধীনে ছিল) মারা যান। তার সময়ের বিভিন্ন উল্লেখযোগ্য শাসক ছিলেন বুদ্ধের শিষ্য যেমন, প্রসেনজিৎ, বিম্বিসার এবং অজাতশত্রু। বৌদ্ধধর্মের কিছু বিখ্যাত বিশুক হলেন সারিপুত্র, আনন্দ, মহাকাসপা, অনুরাধা, উপালি এবং রাহুল। বর্ধমান মহাবীর (জৈনধর্ম) ছিলেন গৌতম বুদ্ধের (বৌদ্ধধর্ম) সমসাময়িক।
0 Comments: