
বিপ্লবের আগে ফরাসি সমাজ ছিল মধ্যযুগীয় ও সামন্ততান্ত্রিক। সমাজে বৈষম্য প্রবলভাবে বিদ্যমান ছিল৷ বিপ্লবের আগে ফ্রান্সের সামাজিক শ্রেণি ও বৈষম্য এই সময় ফরাসি সমাজ মূলত তিনটি সম্প্রদায় বা শ্রেণিতে বিভক্ত ছিল। যথা—
● যাজক সম্প্রদায় বা প্রথম শ্রেণি।● অভিজাত সম্প্রদায় বা দ্বিতীয় শ্রেণি।
● বুর্জোয়া ও কৃষক সম্প্রদায় বা তৃতীয় শ্রেণি।
এই তিনটি শ্রেণির মধ্যে যাজক ও অভিজাত সম্প্রদায় ছিল বিশেষ অধিকারপ্রাপ্ত শ্রেণি এবং তৃতীয় শ্রেণি ছিল অধিকারহীন শ্রেণি।
ফ্রান্সের এই সমাজব্যবস্থাকে দার্শনিক ভলতেয়ার ‘রাজনৈতিক কারাগার’ ও 'এক জাতির মধ্যে তিনটি জাতি' বলে অভিহিত করেছেন।
যাজক সম্প্রদায় বা প্রথম শ্রেণি:
ফরাসি সমাজব্যবস্থায় প্রথম শ্রেণি ছিল যাজক সম্প্রদায়৷ বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে যাজকদের সংখ্যা ছিল ১ লক্ষ ২০ হাজার অর্থাৎ, ফ্রান্সের মোট জনসংখ্যার ০.৫ শতাংশ৷ যাজকদের সংখ্যা অতি সামান্য হলেও ফ্রান্সের সমগ্র কৃষিজমির ০.৫ শতাংশ ছিল যাজকদের গির্জার অধীনে। এই জমির জন্য যাজকরা কোনো নিয়মিত কর দিত না। ‘কনট্রাক্ট অব পোইসি’ নামে এক চুক্তি অনুসারে তারা রাজাকে স্বেচ্ছাকর দিত। গির্জার বিপুল আয় যাজকরা ভোগ করত। এ ছাড়াও যাজকরা জনগণের কাছ থেকে 'টাইদ' বা ধর্মকর, মৃত্যুকর, বিবাহকর প্রভৃতি আদায় করত।
অভিজাত সম্প্রদায় বা দ্বিতীয় শ্রেণি:
অভিজাত সম্প্রদায় ছিল ফ্রান্সের দ্বিতীয় শ্রেণি৷ বিপ্লবের সময় ফ্রান্সে অভিজাতদের মোট সংখ্যা ছিল ৩ লক্ষ ৫০ হাজার, অর্থাৎ দেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.৫ শতাংশ। অভিজাতরা সংখ্যায় সামান্য হলেও ফ্রান্সের কৃষিজমির ০.৫ শতাংশ ছিল অভিজাতদের হাতে। এই জমির জন্য তারা সরকারকে কোনো ভূমিকর দিত না। অভিজাতরা তাদের বংশমর্যাদার জোরে বিভিন্ন ধরনের সুযোগসুবিধা ভোগ করত এবং বিভিন্ন ধরনের সামন্তকর আদায় করত। প্রশাসনিক ও বিচারবিভাগের উচ্চপদগুলি মূলত তাদের অধিকারে থাকায় তারাই শাসন পরিচালনা করত।
বুর্জোয়া ও কৃষক সম্প্রদায় বা তৃতীয় শ্রেণি:
ফরাসি সমাজব্যবস্থায় একদিকে বুর্জোয়া বা মধ্যবিত্ত, ব্যবসায়ী, বুদ্ধিজীবী প্রমুখ সম্পদশালী গোষ্ঠী এবং অন্যদিকে দুঃস্থ কৃষক, দিনমজুর প্রমুখ দরিদ্র জনগোষ্ঠী তৃতীয় শ্রেণির অন্তর্ভুক্ত ছিল। ধনী বুর্জোয়ারা ব্যাবসাবাণিজ্যের মাধ্যমে প্রচুর অর্থসম্পদের মালিক হলেও তারা কখনোই অভিজাতদের সমান সামাজিক মর্যাদা ও অধিকার পেত না। তৃতীয় শ্রেণির একটি বড়ো অংশের মানুষ ছিল দরিদ্র কৃষক, কারিগর, দোকানদার, দিনমজুর প্রমুখ। অনাহার, অর্ধাহার, অত্যাচার ও শোষণে অতিষ্ট এই দরিদ্ররা ফ্রান্সের প্রচলিত সমাজব্যবস্থার ওপর ক্ষুব্ধ ছিল।
ফ্রান্সের সামাজিক বৈষম্য ফরাসি বিপ্লবের অন্যতম কারণ ছিল। ঐতিহাসিক লেফেভর, মাতিয়ে জোরেস প্রমুখ ফরাসি বিপ্লবের সামাজিক কারণের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। ঐতিহাসিক রাইকার বলেছেন যে, ফরাসি বিপ্লব ছিল 'সামাজিক সাম্য অর্জনের উদ্দেশ্যে বুর্জোয়াদের আন্দোলন।'
0 Comments: