হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে আলোচনা করো।


হরপ্পার অধিবাসীরা বহুঈশ্বরবাদ না একেশ্বরবাদ-কোন্ পুজোয় বিশ্বাসী ছিল তা নিয়ে ঐতিহাসিকরা একমত হতে পারেননি। হরপ্পা সভ্যতার অধিবাসীদের ধর্মীয় জীবন সম্পর্কে নীচে আলোচনা করা হল-

উপাসনালয়: হরপ্পা সংস্কৃতিতে দেবদেবীর উপাসনালয় ছিল কি না, তা নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্ক রয়েছে। অনেকে হরপ্পা সভ্যতার অট্টালিকাগুলিকে মন্দির বলেছেন। তবে ঐতিহাসিক এ এল ব্যাসাম-এর মতে, এই অট্টালিকাগুলির কোথাও দেবদেবীর মূর্তি পাওয়া যায়নি।

প্রতীক পুজো (Totem Worship): ঐতিহাসিকদের মতে, হরপ্পার অধিবাসীদের মধ্যে বিভিন্ন রকম 'Totem' বা প্রতীক পুজোর প্রচলন ছিল। যথা-

লিঙ্গ ও যোনি মূর্তির উপাসনা: হরপ্পা সভ্যতার বিভিন্ন কেন্দ্রে বহু লিঙ্গ ও যোনি মূর্তি পাওয়া গেছে। পণ্ডিতদের মতে, এগুলি ছিল উপাসনার বস্তু। প্রজনন সংস্কৃতি (ফার্টিলিটি কাল্ট) হরপ্পার ধর্মীয় জীবনের একটি মুখ্য অঙ্গ ছিল।

প্রাকৃতিক শক্তির উপাসনা: টেরাকোটা ও পাথরের বিভিন্ন প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন থেকে জানা যায় যে, হরপ্পাবাসীরা পিপ্পলিবৃক্ষ (বটগাছ), জল, আগুন, নদী ইত্যাদিকে দেবতাজ্ঞানে পুজো করত। কোনো কোনো সিলে স্বস্তিকা চিহ্ন বা চক্রচিহ্ন সূর্য উপাসনার কথা মনে করায়।

পশু উপাসনা: হরপ্পা সভ্যতায় ষাঁড়, হাতি, গন্ডার, বাঘ, হরিণ, মোষ এমনকি ইউনিকর্ন-সহ একাধিক পশুর পুজো করা হত বলে পণ্ডিতরা মনে করেন।
  
     এ ছাড়া অলৌকিক অশুভ শক্তিতেও তাদের বিশ্বাস ছিল। এই সকল শক্তির হাত থেকে বাঁচার জন্য তারা নরবলি দিত, কবচ ও মাদুলি ব্যবহার করত।

দেবমূর্তির উপাসনা: তিনটি শৃঙ্গবিশিষ্ট, পাঁচটি পশু পরিবৃত, যোগাসনে বসা এক পুরুষ মূর্তির সিলমোহর মহেনজোদাড়োয়পাওয়া গেছে। মূর্তিটির আসনের নীচে ছিল একটি হরিণ। স্যার জন মার্শাল একে পশুপতি শিব বা আদি শিব (Proto-Shiva)-এর মূর্তি বলে উল্লেখ করেছেন। (The later concept of Shiva John Marshal).

মাতৃমূর্তির উপাসনা: হরপ্পায় বহুসংখ্যক মাটির তৈরি পাওয়া গেছে, সেগুলিকে হরপ্পাবাসীরা দেবীজ্ঞানে পুজো করত। অপর একটি সিলে এমন একটি নারীমূর্তি পাওয়া গেছে, যার গর্ভ থেকে চারাগাছ বের হয়েছে। পণ্ডিতেরা এই মূর্তিকে পৃথিবী দেবী বা উর্বরতার দেবী বলে উল্লেখ করেছেন।

পারলৌকিক বিশ্বাস: মিশরীয়দের মতো হরপ্পার মানুষও পরলোক এবং আত্মার পুনর্জন্ম বিষয়ে বিশ্বাসী ছিল। এই কারণে তারা মৃতদেহকে সমাধিস্থ করত।

ধর্মীয় প্রতীকের প্রাপ্তি: হরপ্পা সভ্যতায় ধর্মীয় বিশ্বাসের সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতীক (পদ্ম, মাতৃমূর্তি স্বস্তিক চিহ্ন, চক্র, স্তম্ভ, ত্রিশূল ইত্যাদি) জড়িত বলে পণ্ডিতগণ অনুমান করেছেন।

    ড. এ এল ব্যাসাম হরপ্পা সভ্যতাকে ধর্মকেন্দ্রিক বললেও মার্টিমার হুইলার মনে করেন যে, হরপ্পা সভ্যতা ধর্মনিরপেক্ষ ছিল। নিদর্শন ও প্রমাণ সাপেক্ষে বলা যায়, এখানকার জনজীবনে ধর্ম ছিল একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান, যার মধ্যে ভারতীয় ধর্মের আদি পরিচয় পাওয়া যায়।

0 মন্তব্যসমূহ