ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের প্রভাব বা ফলাফল সংক্ষেপে আলোচনা করো :


প্রায় দুশো বছরব্যাপী স্থায়ী আটটি অভিযান এবং প্রায় কুড়ি লক্ষ মানুষের আত্মবলিদান সত্ত্বেও জেরুজালেম পুনরুদ্ধার করা খ্রিস্টানদের পক্ষে সম্ভব হয়নি। ক্রুসেডের ইতিবাচক ও নেতিবাচক দুরকম প্রভাব লক্ষণীয়। 

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ইতিবাচক প্রভাব: 
রাজনৈতিক প্রভাব:
মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব: সামন্ততন্ত্রের পতনের পর স্বাধীন কৃষক ও শ্রমিকদের হাতে অর্থের প্রাচুর্য দেখা দেয়, ফলে ইউরোপে মধ্যবিত্ত শ্রেণির উদ্ভব হয় এবং তাদের প্রচেষ্টায় ছোটো ছোটো শিল্পপ্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠে।

জাতীয় চেতনা বৃদ্ধি: ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের ক্রুসেডে যোগদানের ফলে জাতীয় চেতনা ও জাতীয় রাষ্ট্রের ভিত্তি সুপ্রতিষ্ঠিত হয়। 

অর্থনৈতিক প্রভাব:
আর্থিক সমৃদ্ধি: ক্রুসেডে মৃত সামন্তদের ভূসম্পত্তি রাজার অধীনস্থ হওয়ায় রাজাদের আর্থিক সম্পদ বৃদ্ধি পেতে থাকে। এ ছাড়া বণিক ও মহাজন শ্রেণি অনেক ধর্মযোদ্ধাকে সম্পত্তি বন্ধকির বিনিময়ে ঋণ দেন। এ থেকে তারাও লাভবান হয়। 

নতুন শহরের পত্তন:
ক্রুসেড চলাকালীন ইউরোপের পুরোনো শহরগুলির শ্রীবৃদ্ধি ঘটার পাশাপাশি ভেনিস, জেনোয়া, পিসা, নেপলস, মার্সেই প্রভৃতি নতুন নতুন শহরও গড়ে উঠেছিল। 

সামাজিক প্রভাব:
ভূমিদাস শ্রেণির উত্থান: পোপ দ্বিতীয় আরবানের ক্লেয়ারমন্ট ধর্মসম্মেলনে ঘোষণার প্রেক্ষিতে ক্রুসেডে যোগদানকারী ভূমিদাসরা যুদ্ধশেষে স্বাধীন নাগরিক হয়ে শহরে শিল্পী বা কারিগর কিংবা উদীয়মান বুর্জোয়া শ্রেণির শ্রমিক বা সহযোগীতে পরিণত হয়। এভাবে সমাজে একটি নতুন সামাজিক শ্রেণি হিসেবে এই ভূমিদাসরা পরিচিত হতে থাকে। 

বণিক ও মহাজন শ্রেণির উত্থান: ইউরোপের বণিক ও মহাজন শ্রেণির থেকে ঋণগ্রহণকারী সামন্তপ্রভুরা ক্রুসেডে গিয়ে মৃত্যুবরণ করলে বা নিঃস্ব হয়ে ফিরে এলে তাদের জমিগুলি বণিক ও মহাজন শ্রেণির হাতে চলে আসে। ফলে এই শ্রেণিই পরবর্তীতে ইউরোপের চালিকাশক্তিতে পরিণত হয়। 

সাংস্কৃতিক প্রভাব:
জ্ঞানের বিকাশ: ক্রুসেডের ফলে প্রাচ্য ও পাশ্চাত্যের মধ্যে জ্ঞানের আদানপ্রদানের সূত্রে এশিয়ার কাগজ, কম্পাস, আতস কাচ প্রভৃতি বৈজ্ঞানিক প্রযুক্তি ইউরোপে পৌঁছোয়। ফলে সেখানে জ্ঞান-বিজ্ঞানের দ্রুত বিস্তার ঘটে। 

নবজাগরণের সূচনা: পঞ্চদশ শতকে ইউরোপে যে নবজাগরণের সূচনা ঘটেছিল সেখানে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব দিল। ঐতিহাসিক টয়েনবির মতে ক্রুসেডের ফলেই আধুনিক ইউরোপের জন্ম হয়। 

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব:
ব্যাপক ধ্বংসলীলা ও মৃত্যু: প্রায় দুশো বছরব্যাপী সংঘটিত ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও ধ্বংসলীলা খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে পারস্পরিক ঘৃণার ভাব সৃষ্টি করে। 

সম্পদের অপচয়: ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধে বহুসংখ্যক মানুষের মৃত্যুর পাশাপাশি প্রচুর ধনসম্পত্তিরও অপচয় হয়, যা এক দুর্দশাপূর্ণ জীবনের সূচনা করে।

0 মন্তব্যসমূহ