ঋকবৈদিক যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবন:
আর্যরা বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তিকে দেবতা জ্ঞানের পূজা করত। সূর্যোদয়, চন্দ্রোদয়, বৃষ্টিপাত ও বন্যা-সহ বিভিন্ন প্রাকৃতিক ঘটনার ওপর দেবত্ব আরােপ করে। ঋকবৈদিক আর্যদের ধর্মজীবনের বৈশিষ্ট্যগুলি নিম্নরূপ—
সর্বপ্রাণবাদ:
ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা আদিম সর্বপ্রাণবাদে অর্থাৎ সর্বত্র প্রাণের অস্তিত্বে বিশ্বাসী ছিলেন। এই বিশ্বব্রয়াণ্ডের চেতন-অবচেতন সমস্ত পদার্থের মধ্যেই তারা ঈশ্বরের অস্তিত্ব অনুভব করত।
পুরুষ দেবতার প্রাধান্য:
ঋকবৈদিক যুগে পুরুষ দেবতাদেরই প্রাধান্য ছিল। নারী দেবতারা সংখ্যায় ও গুরুত্বে ছিলেন নিতান্তই কম। তবে ঋগ্বৈদিক ঋষিদের কাছে কোনাে একজন দেবতা বিশেষভাবে গুরুত্ব পাননি বা সর্বশ্রেষ্ঠ বলে বিবেচিত হননি।
অপৌত্তলিকতাবাদ ও একেশ্বরবাদ:
বহু দেবদেবীর আরাধনা করলেও আর্যরা পৌত্তলিক ছিল না। ঋকবৈদিক আর্যরা এক-এক সময় এক-এক দেবতাকে সর্বশ্রেষ্ঠ বা সর্বশক্তিমান বলে মনে করত, যা অনেক একেশ্বরবাদ (Henotheism) নামে পরিচিত।
যাগযজ্ঞ ও বলিদান:
আর্যদের ধর্মের অন্যতম প্রধান বৈশিষ্ট্য ছিল যজ্ঞানুষ্ঠান ও বলিদান প্রথা। দেবতাদের সন্তুষ্ট করার জন্য যজ্ঞ উপলক্ষ্যে যড় বলি দেওয়া হত। যজ্ঞানুষ্ঠান পরিচালনার একচেটিয়া অধিকার ছিল ব্রাম্মণ পুরােহিতদের হাতে।
জন্মান্তরবাদ:
আর্যরা বিশ্বাস করত যে মৃত্যুর পর কর্মফল ভােগ করার জন্য মানুষ পুনরায় জন্মগ্রহণ করে।
আরাধ্য দেবতাগণ:
ঋকবৈদিক যুগে আর্যরা বহু দেবদেবীর পূজায় বিশ্বাসী ছিল। ঋকবৈদিক যুগের বিভিন্ন দেবতাদের মধ্যে উল্লেখযােগ্য ছিলেন—
ইন্দ্র: দেবতাদের রাজা। ইন্দ্র যুদ্ধ ও বজ্রের দেবতা।
অগ্নি: দেবতাদের পুরােহিত, যজ্ঞের আহুতি গ্রহণকারী ও মানুষের মধ্যে সংযােগরক্ষাকারী দেবতা।
বরুণ: পাপপুণ্যের ধারক।
মিত্র: সন্ধি, শপথ ও প্রতিজ্ঞা রক্ষার দেবতা।
বায়ু: বাতাসের দেবতা।
সােম: বৃক্ষাদির দেবতা।
মরুৎ: ঝড়ের দেবতা।
পর্জন্য: বৃষ্টির দেবতা।
সূর্য: আলাের দেবতা।
যম: মৃত্যুর দেবতা।
রুদ্র: ধবংসের দেবতা।
পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবন:
পরবর্তী বৈদিক যুগে আর্যদের ধর্মীয় জীবনে যাগযজ্ঞ ও ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানগুলি জটিল রূপ ধারণ করে। এসময়ে আন্তরিক ভক্তি ও ধর্মীয় ভাবনার উধের্ব স্থান পেয়েছিল ধর্মের আচার অনুষ্ঠানগুলি।
পুরোহিতদের সংখ্যা ও মর্যাদা বৃদ্ধি:
যাগযজ্ঞের জটিলতা ও গুরুত্ব বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে পুরোহিত শ্রেণির সংখ্যা ও মর্যাদা দুই ই বৃদ্ধি পায়। কাজের বিভিন্নতা অনুযায়ী আলাদা আলাদা পুরােহিতের প্রয়ােজন দেখা দেয়। যেমন—
হােত্রী: যিনি মন্ত্রপাঠ করে দেবতাকে আহবান করতেন।
উদগাত্রী: যিনি সামবেদ গাইতেন।
অধবর্যু: যিনি পুথি থেকে মন্ত্র উচ্চারণ করতেন।
পুরােহিত: যিনি মন্ত্র পাঠ করার সঙ্গে যজ্ঞে হবি বা ঘৃত দিতেন৷
দেবতাদের গুরুত্বের ক্ষেত্রে পরিবর্তন:
পরবর্তী বৈদিক যুগে প্রজাপতি ব্রহ্মা সর্বোচ্চ মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হন। ঋকবৈদিক যুগের গুরুত্বহীন দেবতা বিষ্ণুর মর্যাদাও এ যুগে বাড়ে। ঋগ্বৈদিক দেবতা রুদ্র এ যুগে শিবে রূপান্তরিত হন। এ যুগে ইন্দ্রের গুরুত্ব ধীরে ধীরে কমতে থাকে।
একেশ্বরবাদের জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি:
একেশ্বরবাদী ধারণা এ যুগে আরও জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। এসময় থেকেই মানুষের দৃঢ় ধারণা হয় যে, ঈশ্বর এক এবং অদ্বিতীয়। বহু দেবতার মধ্যে দিয়ে একই ঈশ্বর বিভিন্নরূপে প্রকাশিত হন। এ যুগের ধারণা ছিল প্রজাপতি ব্রয়াই হলেন এক ও অদ্বিতীয় ঈশ্বর।
নতুন দেবদেবীগণের আবির্ভাব:
পূর্ববর্তী যুগের দেব দেবীদের পাশাপাশি এ যুগে নতুন কয়েকজন দেবদেবীর পুজো শুরু হয়।
যেমন— প্রজাপতি, কুবের, জয়ন্ত, গরুড়, নারায়ণ, বাসুদেব, উমা, হৈমবতী প্রমুখ।
0 মন্তব্যসমূহ