খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত মধ্যযুগে ইউরোপে যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা সাধারণভাবে 'সামন্ততন্ত্র' নামে পরিচিত। ইতিহাসবিদ মার্ক ব্লখ ও গ্যানশফ খ্রিস্টীয় দশম থেকে দ্বাদশ শতককে সামন্ততন্ত্রের 'ধ্রুপদি যুগ'(Classical Age) বলে অভিহিত করেছেন। সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের পশ্চাতে ঐতিহাসিকগণ বিভিন্ন কারণ উল্লেখ করেছেন। যথা-
কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতা: সম্রাট শার্লাম্যানের মৃত্যুর পর তাঁর দুর্বল উত্তরাধিকারীদের সময় কেন্দ্রীয় শক্তির নিয়ন্ত্রণ সম্পূর্ণ শিথিল হয়ে পড়ে। কেন্দ্রীয় শক্তির দুর্বলতার সুযোগে একের পর এক বর্বর আক্রমণ ঘটে। এর ফলে পশ্চিম ইউরোপে এক বিশৃঙ্খল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়। মার্ক ব্লখের মতে- "অন্তহীন এই সংকটের মধ্যেই আবির্ভাব ঘটেছিল সামন্ততন্ত্রের।”
বর্বর জাতির আক্রমণ: ক্যারোলিঞ্জীয় রাজপরিবারের অন্তর্দ্বন্দ্বের সুযোগ নিয়ে ম্যাগিয়ার, ভাইকিং, সারাসেন প্রভৃতি বর্বর জাতিগুলি আক্রমণ করে ইউরোপে এক চরম অরাজক পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। ফলে সাধারণ মানুষ নিরাপত্তা ও সম্পত্তি রক্ষার স্বার্থে স্থানীয় ভূস্বামী বা সামরিক ক্ষমতাসম্পন্ন ব্যক্তির আনুগত্য মেনে নেয়। এইভাবে কেন্দ্রীয় শাসকের পরিবর্তে স্থানীয় ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভুরা শাসন পরিচালনার ক্ষেত্রে সর্বেসর্বা হয়ে ওঠেন।
ব্যাবসাবাণিজ্যের অবনতি: ঐতিহাসিক হেনরি পিরেন সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবের নতুন ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে, অষ্টম শতকে ভূমধ্যসাগরীয় বাণিজ্যে মুসলমানদের একাধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিম ইউরোপে ব্যাবসাবাণিজ্যের অবনতি ঘটে। ফলে ইউরোপে বাণিজ্য নির্ভর অর্থনীতির পরিবর্তে জমিভিত্তিক সামন্ত অর্থনীতির উদ্ভব ঘটে।
অনুগামী পৃষ্ঠপোষক সম্পর্ক: ঐতিহাসিক আবে দুবো বলেছেন, প্রাচীন রোমে ভূস্বামী বা ধনী অভিজাত ব্যক্তির প্রতি বহু সাধারণ মানুষ জীবন ও নিরাপত্তার স্বার্থে আনুগত্য জানিয়ে সেবাদান করত। এটি 'অনুগামী-পৃষ্ঠপোষক প্রথা' (Client Patron System) নামে পরিচিত। এই প্রথার অনুকরণেই পরবর্তীকালে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল।
জার্মান কমিটেটাস প্রথা: ঐতিহাসিক বোলাঁভিয়ের বলেছেন, জার্মানিতে স্বাধীন যোদ্ধারা আশ্রয় ও নিরাপত্তার স্বার্থে শক্তিশালী কোনো সামরিক নেতার প্রতি স্বেচ্ছায় আনুগত্য জানাত। তাঁর মতে, জার্মানির এই কমিটেটাস প্রথা অনুসরণেই পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব ঘটেছিল।
মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, খ্রিস্টীয় নবম শতকে ক্যারোলিঞ্জীয় সাম্রাজ্যের ভাঙন, বহিরাগত বর্বর আক্রমণ, ব্যাবসাবাণিজ্যের অবনতি, রোমান ও জার্মান প্রথা সামন্ততন্ত্রের উদ্ভবে সহায়ক হয়েছিল।
0 মন্তব্যসমূহ