ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধের কারণ সংক্ষেপে আলোচনা করো।


ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ ইতিহাসে অন্যতম আলোচ্য বিষয়। মুসলমান খ্রিস্টানদের মাঝে সংঘটিত হয় এ যুদ্ধ। প্রায় তিন শতাব্দী পর্যন্ত স্থায়ী ছিল। এটি খ্রিস্টানদের প্রধানকর্তা ও ধর্মগুরু পোপ আরবান-২ এ যুদ্ধ ঘোষণা করেন। ক্ষমতালোভী ও ধর্ম ব্যবসায়ী খ্রিস্টান যাজকতন্ত্র মুসলমানদের বিরুদ্ধে এ যুদ্ধ পরিচালনা করে।

ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত কারণ ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ– 

ধর্মীয় কারণ:
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত ধর্মীয় কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ– 

রােমান চার্চের হৃতগৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা: ১০৫৪ খ্রিস্টাব্দে গ্রিক চার্চের সঙ্গে রােমান চার্চের সম্পর্ক ছিন্ন হয়ে গিয়েছিল। তাই পােপ দ্বিতীয় আরবান রােমান চার্চের হৃত গৌরব পুনঃপ্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন মুসলমানদের বিরুদ্ধে ক্রুসেডে আন্দোলনে জয়ী হলে খ্রিস্টানদের ওপর নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা অনেক সহজ হবে। 

জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষা: জিশুখ্রিস্টের জন্মভূমি প্যালেস্টাইনের অন্তর্গত জেরুজালেম ছিল খ্রিস্টানদের পবিত্র তীর্থস্থান। ১০৭১ খ্রিস্টাব্দে সেলজুক তুর্কিরা জেরুজালেমের দখল নেয়। খ্রিস্টান যাজক, অভিজাত এবং রাজাগণ সংঘবদ্ধ হন ও সেলজুক তুর্কিদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ প্রস্তুতি শুরু করেন। 
আবার অন্যদিকে মুসলমানদের কাছে জেরুজালেম ছিল হজরত মহম্মদ, হজরত মুসা ও হজরত দাউদের স্মৃতিবিজড়িত পবিত্রভূমি। তাই মুসলিমরাও জেরুজালেমের পবিত্রতা রক্ষায় উদ্যত হলে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। 

রাজনৈতিক কারণ:
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত রাজনৈতিক কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ– 

ইসলামের গতি রােধ: হজরত ওমরের আমল থেকে, রাজ্যবিজয় ও ধর্মপ্রচারের মধ্যে দিয়ে ইসলামের সম্প্রসারণ শুরু হয়। রােমান সাম্রাজ্যের অন্তর্গত মিশর, সিরিয়া, স্পেন, উত্তর আফ্রিকা, দক্ষিণ ইটালি, সিসিলি-সহ সমগ্র পশ্চিম ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চল মুসলমানদের অধিকারে আসে। খ্রিস্টানরা ইসলাম সাম্রাজ্য বিস্তারের এই গতি রােধে সচেষ্ট হয়।

নিজ দক্ষতা প্রদর্শনের আকাঙ্ক্ষা: অষ্টম শতকের মাঝামাঝি সময়কালে ফ্রাঙ্করাজ চার্লস মাটেল আরবদের আক্রমণ রােধের লক্ষ্যে এক সুনিপুণ যােদ্ধাবাহিনী গড়ে তােলেন। খ্রিস্টধর্মের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ের একটা সুযোগ পাওয়ার জন্য তারা ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচনায় সাহায্য করে। 

অর্থনৈতিক কারণ:
ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ সংঘটিত হওয়ার পিছনে যে সমস্ত অর্থনৈতিক কারণগুলি ছিল সেগুলি হল নিম্নরূপ– 

সামন্তপ্রথার প্রবর্তন: একাদশ শতকে ইউরোপের সামন্তপ্রভুরা প্রাচ্যে ভূখণ্ড দখল করে সামন্তপ্রথার বিস্তারে উদ্যোগী হন। তারা সেখানে সামন্তপ্রথা প্রবর্তন ও পরাজিতদের শােষণের মাধ্যমে সম্পদ বৃদ্ধির লক্ষ্যে ক্রুসেডে যােগ দেন। 

অভিজাতদের লােভ: যে সমস্ত অভিজাতর ম্যানরের আয় কমে গিয়েছিল, তারা এবং লােভী অভিজাতরা লুঠতরাজের মাধ্যমে ধন উপার্জনের লক্ষ্যে ধর্মযুদ্ধে যােগ দিয়েছিল।

বাণিজ্যিক স্বার্থ: পশ্চিম রােমান সাম্রাজ্যের পতনের পর ব্যাবসাবাণিজ্যের ক্ষেত্রে খ্রিস্টান বণিকগণ কোণঠাসা হয়ে পড়ে। একাদশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে পরিস্থিতি বদলায়। নর্ম্যানরা মুসলমানদের কাছ থেকে সিসিলি কেড়ে নেয় এবং খ্রিস্টান শক্তি স্পেন অধিকার করে। ইটালির বণিকরা প্রাচ্য দেশগুলির সঙ্গে সরাসরি বাণিজ্যিক সম্পর্ক গড়ে তােলে। 
এই বাণিজ্যিক সম্পর্কের টানাপােড়েনে খ্রিস্টান ও মুসলমানদের মধ্যে ক্রুসেডের প্রেক্ষাপট রচিত হয়। 

সামাজিক কারণ:
ভূমিদাসদের মুক্তির আকাক্ষা: ক্রুসেডে অংশগ্রহণ করলে ভূমিদাসদের দাসত্ব থেকে মুক্তি দেওয়ার ও ঋণগ্রহণকারীদের সুদের হার কমানাের প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। তাই ক্রুসেডে যােগ দিয়ে ভূমিদাসত্ব থেকে মুক্ত হতে চেয়েছিল হাজার হাজার সার্ফ বা ভূমিদাস। 

জনসংখ্যার আধিক্য: মধ্যযুগে জনসংখ্যার চাপ বৃদ্ধি পেলেও সেই অনুপাতে জমির পরিমাণ বাড়েনি। ফলে জমির ওপর নির্ভরশীলদের একাংশ নতুন ভূখণ্ডে শান্তিতে বসবাসের লক্ষ্যে ক্রুসেডের সঙ্গে নিজেদেরকে যুক্ত করে।

তীর্থযাত্রীদের ক্ষোভ: একাদশ শতকে জেরুজালেম সেলজুক তুর্কিদের অধিকৃত হওয়ার পরও বহু খ্রিস্টান তীর্থযাত্রী জেরুজালেম ভ্রমণে আসতে থাকেন। 
তীর্থযাত্রাকালীন তাদের অনেকেই দস্যুদের কবলে পড়েন ও আক্রান্ত হন। ফলে খ্রিস্টানগণ মুসলিমদের বিরুদ্ধে দারুণ ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। 

প্রত্যক্ষ কারণ: 
১০৯৫ সালের ২৬ নভেম্বর দক্ষিণ পূর্ব ফ্রান্সের ক্লারমেন্ট শহরে খ্রিস্টানদের প্রধান কর্তা পোপ আরবান-২ একটি সুদূরপ্রসারী ভাষণ দেন এবং তিনি মুসলমানদের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালান। বাইজান্টাইন সম্রাট আলফ্রিস কমনেনাস আবেদন ও পোপের প্রচারণা এ যুদ্ধের প্রত্যক্ষ কারণ। 

পরিশেষে বলা যায় যে, ইতিহাসের এক জঘন্যতম অধ্যায় হচ্ছে ক্রুসেড বা ধর্মযুদ্ধ। জেরুজালেম দখল করার জন্য খ্রিস্টানরা নিরীহ মুসলমানকে হত্যা করে।

0 মন্তব্যসমূহ