খ্রিস্টীয় নবম থেকে ত্রয়োদশ শতক পর্যন্ত পশ্চিম ইউরোপে যে আর্থসামাজিক ও রাজনৈতিক ব্যবস্থা প্রচলিত ছিল, তা সাধারণভাবে 'সামন্ততন্ত্র' (Feudalism) নামে পরিচিত। তবে ইউরোপের সর্বত্র সামন্ততন্ত্রের উদ্ভব, বিকাশ বা প্রকৃতি একইরকম ছিল না। তাসত্ত্বেও বিভিন্ন দেশে প্রচলিত সামন্ততন্ত্রের মধ্যে কতকগুলি সাধারণ বৈশিষ্ট্য লক্ষ করা যায়। এগুলি হল-
স্তরবিন্যস্ত প্রথা বা ব্যবস্থা: ইউরোপের সামন্ততান্ত্রিক কাঠামোয় একটি ক্রমোচ্চ স্তরবিন্যাস লক্ষ করা যায়। সামন্ততান্ত্রিক স্তরবিন্যাসের শীর্ষে ছিলেন রাজা এবং তার নীচে ছিলেন ডিউক, আর্ল, ব্যারন, নাইট প্রমুখ বিভিন্ন স্তরের ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভুরা। আর সর্বনিম্ন স্তরে। ছিলেন দরিদ্র কৃষক ও স্বাধীনতাহীন ভূমিদাস। সামন্ততন্ত্রের স্তরবিন্যস্ত কাঠামোটি দেখতে অনেকটা পিরামিডের মতো।
ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভুদের আধিপত্য: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় দেশে রাজার পরিবর্তে স্থানীয় ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভুদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অর্থাৎ রাজা রাষ্ট্রের সকল ক্ষমতার উৎস হলেও প্রকৃত শাসনক্ষমতা আঞ্চলিক সামন্তপ্রভুদের হাতেই কুক্ষিগত ছিল।
ম্যানর ব্যবস্থা: কার্ল মার্কস ম্যানর ব্যবস্থাকে সামন্ততন্ত্রের গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য বলে উল্লেখ করেন। সামন্তপ্রভুর অধীনস্থ গ্রামগুলিকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠত ম্যানর ব্যবস্থা। ম্যানর বা খামারবাড়িতে উৎপাদিত শস্য ও পণ্যসামগ্রী ভোগদখল করতেন সামন্তপ্রভুরা। ম্যানর ছিল সামন্তপ্রভুদের অধীনস্ত কৃষক ও ভূমিদাসদের শোষণের মূলক্ষেত্র।
ফিফ ও ভ্যাসালেজ: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হল ফিফ ও ভ্যাসালেজ প্রথা। প্রত্যেক ঊর্ধ্বতন সামন্তপ্রভু তাঁর অধস্তন সামন্ত (ভ্যাসাল)-কে ফিফ (Fief) বা জমি দান করতেন। এর বিনিময়ে ভ্যাসালরা লর্ডের প্রতি আনুগত্য, সেবা ও বিশ্বস্ততার শপথগ্রহণ করতেন। সামন্তপ্রভু ও ভ্যাসালের মধ্যে আনুগত্য ও নিরাপত্তা রক্ষার এই ধরনকে ঐতিহাসিক মার্ক ব্লখ 'ভ্যাসালেজ' বলেছেন।
যোদ্ধা শ্রেণির অস্তিত্ব: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় বীর যোদ্ধা শ্রেণি হিসেবে নাইট-দের অস্তিত্ব লক্ষ করা যায়। প্রভু ও তাঁর অধীনস্ত প্রজাদের সুরক্ষা এবং অভ্যন্তরীণ বিশৃঙ্খলা দমন করাই ছিল নাইটদের প্রধান দায়িত্ব।
আনুগত্যের সম্পর্ক: সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্যতম বৈশিষ্ট্য ছিল ঊর্ধ্বতন প্রভুর কাছে অধস্তনের অকৃত্রিম আনুগত্য প্রদর্শন। এভাবে বিভিন্ন স্তরের সামন্তপ্রভু ও তাঁর অধস্তনদের মধ্যে আনুগত্যের সম্পর্ক গড়ে উঠেছিল।
কৃষক ও ভূমিদাস শোষণ: মার্ক ব্লখ-এর মতে, সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থায় প্রভুরা তাঁর অধীনস্ত কৃষক ও ভূমিদাসদের নানাভাবে শোষণ করতেন। মরিস ডব সহ অনেকেই ভূমিদাসত্ব-কে সামন্ততন্ত্রের মূলভিত্তি বলে উল্লেখ করেছেন।
মূল্যায়ন: সবশেষে বলা যায় যে, ভূমি বা জমি বণ্টনের ভিত্তিতেই পশ্চিম ইউরোপে সামন্ততান্ত্রিক ব্যবস্থা বিকশিত হয়েছিল। এই ব্যবস্থায় কেন্দ্রীয় রাজশক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং ভূস্বামী বা সামন্তপ্রভুদের ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব বৃদ্ধি পায়।
0 মন্তব্যসমূহ