সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ: (Causes of decline of Indus Valley Civilization).


১৯২১ সাল থেকে ১৯২২ সালে ঐতিহাসিক রাখালদাস বন্দ্যোপাধ্যায়, দয়ারাম সাহানি, স্যার জন মার্শাল এর প্রচেষ্টায় হরপ্পা ও মহেঞ্জোদারোকে কেন্দ্র করে সিন্ধু সভ্যতার আবিষ্কার ঘটে। সিন্ধু সভ্যতার সময়কাল হল আনুমানিক ৩০০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ থেকে ১৫০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দ পর্যন্ত। এই সভ্যতার বিস্তৃতি প্রায় ১২.৫ লক্ষ বর্গ কিমি। যেটি বর্তমান পাকিস্তান ও ভারতবর্ষের মধ্যে বিস্তৃত ছিল। কালের প্রবাহে বিভিন্ন সভ্যতার যেমন পতন ঘটেছিল ঠিক তেমনি আধুনিক সভ্যতার মতো হয়েও সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ (Causes of decline of Indus Valley Civilization) বিভিন্ন দিক থেকে পরিলক্ষিত হয়, সেগুলি হল-


প্রাকৃতিক কারণ: প্রাকৃতিক বিভিন্ন কারণে সিন্ধু সভ্যতা ধীরে ধীরে পতন বা ধ্বংসের দিকে এগিয়ে যায়। তাই বিশিষ্ট ঐতিহাসিক রণবীর চক্রবর্তী প্রাকৃতিক কারণের মধ্যে পরিবেশগত কারণকে বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। তাঁর মতে– পরিবেশগত পরিবর্তন সিন্ধু সভ্যতার অস্তিত্ব বিপন্ন করে তুলেছিল। যেমন খ্রিস্টপূর্ব ২২০০ এর সময় থেকে দক্ষিণ এশিয়ার বিস্তীর্ণ অঞ্চলে বৃষ্টিপাতের পরিমাণ হ্রাস পায়। ফলে অপেক্ষাকৃত শুষ্ক। জলবায়ুর জন্য কৃষিভিত্তিক সভ্যতা গুলি জীবন ধারণের পক্ষে প্রতিকূল হয়ে ওঠে। 


মনুষ্য সৃষ্ট কারণ: মনুষ্য সৃষ্ট বিভিন্ন কারণে সিন্ধু সভ্যতা ধীরে ধীরে বিলুপ্ত হয়েছিল। নির্বিচারে অরণ্য ছেদন এই সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করা হয়। কারণ সিন্ধু সভ্যতার যুগে ঘর বাড়ি ছিল পোড়া ইটের তৈরি। আর এই ইট গুলি তৈরির জন্য নির্বিচারে অরণ্য ধ্বংস করা হয়। 

তাছাড়া বহু জঙ্গল কেটে সভ্যতার পরিধি বৃদ্ধি করা হয়। বিশিষ্ট ঐতিহাসিক হুইলারের মতে নির্বিচারে অরণ্য ছেদনের ফলে ধীরে ধীরে সিন্ধু উপত্যকায় বৃষ্টির পরিমাণ কমে যায় এবং মরুভূমি সৃষ্টি হয়। 


সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন এবং বন্যা: অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন সিন্ধু নদের গতিপথ পরিবর্তন হওয়ার ফলে এই সভ্যতার পতন ঘটেছিল। তাছাড়া বারবার বন্যা সিন্ধু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী করা হয়। খননকার্যের ফলে মহেঞ্জোদারোতে অত্যন্ত তিনবার বিধ্বংসী বন্যার প্রমাণ পাওয়া যায়। তাই বারবার বন্যার ফলে সিন্ধু নগরের প্রাচীর বেশ কয়েকবার বিনষ্ট হয়েছে। অনেক ঐতিহাসিক বলেন বন্যার হাত থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য ৪৩ ফুট নদীবাঁধ তৈরি করা হলেও বন্যা আটকানো যায়নি। তাছাড়া এই সভ্যতার আশেপাশের অঞ্চলে দীর্ঘদিন জলমগ্ন থাকার ফলে এই সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়েছিল। 


মরুভূমির প্রসার: সিন্ধু সভ্যতার মানুষেরা ইটের তৈরি ঘরবাড়ি এবং সভ্যতার বিস্তার সাধনের জন্য যথেষ্টভাবে অরণ্য ছেদন করেছিল। তাছাড়া বিভিন্ন কারণে এই অঞ্চলে দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টিপাতের অভাব পরিলক্ষিত হয়। ফলে মরুভূমির প্রসার ঘটে। যা সিন্ধু সভ্যতার পতনকে অনিবার্য করে তুলেছিল। 


রক্ষণশীল মনোভাব: সিন্ধু সভ্যতা উন্নত সভ্যতা হলেও সময়ের সাথে সাথে মানিয়ে নিতে ব্যর্থ হয়েছিল। অর্থাৎ তাদের রক্ষণশীল মানসিকতা বা মনোভাব পরিবর্তনশীল প্রকৃতিকে মানিয়ে নিতে পারেনি। তাই কৃষি ও বাণিজ্যের উন্নতির সাথে সাথে তারা সেই বিষয়ে গুরুত্ব দেয়নি। ফলে সময়ের সাথে সাথে রক্ষণশীল মানসিকতার জন্য সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটেছিল বলে, অনেক ঐতিহাসিকগণ মনে করেন। 


বহিরাগতদের আক্রমণ: বহিরাগতদের আক্রমণ ঠেকাতে সিন্ধু বাসীরা উঁচু উঁচু পাঁচিল বা প্রাচীর তুলেছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও বারবার বহিরাগত আক্রমণ এই সভ্যতার পতনকে অনিবার্য করেছিল। 

তাছাড়া ঐতিহাসিক গর্ডন চাইল্ড, কোশাম্বী প্রমুখ বলেছেন আর্য জাতির আক্রমণের ফলে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে। কারণ মহেঞ্জোদারোতে খননকার্য থেকে পাওয়া ছড়িয়ে থাকা মানুষের কঙ্কালের খুলিতে আঘাতের চিহ্ন পাওয়া গেছে। এই প্রত্নতাত্ত্বিক প্রামাণ্যের উপর ভিত্তি করে ঐতিহাসিকগণ মনে করেন যে বৈদেশিক আক্রমণ হিন্দু সভ্যতার পতনের জন্য দায়ী। 


     পরিশেষে বলা যায়, সিন্ধু সভ্যতার পতনের কারণ কোনো একটি নির্দিষ্ট কারণে ঘটেনি। বরং বিভিন্ন ঘটনার পরম্পরায় সিন্ধু সভ্যতার পতন অনিবার্য হয়ে উঠেছিল। কোথাও বন্যা বা ভূমিকম্প আবার কোথাও বহিরাগতদের আক্রমণ কিন্তু সভ্যতার জনজীবনকে বিপর্যস্ত করে তুলেছিল। ফলে ধীরে ধীরে কয়েকশো বছরের মধ্যে সিন্ধু সভ্যতার পতন ঘটে।

0 মন্তব্যসমূহ